আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ তাঁর সৃষ্টির মাঝে

 


এ মহাজগতে বিদ্যমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনু থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি সবকিছুই আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। সাতস্তর আসমানসাতস্তর  যমীনমহাশূন্যে বিরাজমান লক্ষকোটি গ্রহ-তারাসাগর-মহাসাগরপাহাড়-পর্বত সবই মহাপালনকর্তা আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁর মহাসত্তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন

اَفِي اللهِ شَكٌّ فَاطِرِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ.

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ব্যাপারে কি তোমরা সন্দেহের মধ্যে রয়েছসূরা ইবরাহীম (১৪) : ১০

মহাজগতে প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ সমুজ্জ্বলরূপে বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের অসংখ্য নিদর্শন মানব সৃষ্টি এবং সৃষ্টিকুলের অপরাপর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে বিরাজমান।

প্রবাদ রয়েছে স্থাপত্য দেখে স্থপতি চেনা যায়লেখা দেখে লেখক চেনা যায়কবিতা দেখে কবির পরিচয় পাওয়া যায়। তাহলে কি এ বিশাল সৃষ্টি ও তাতে বিদ্যমান নিদর্শনাবলি দেখে এ সবের অস্তিত্ব দানকারী আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া  যায় না?

আল্লাহ তাআলা মহাজগতে তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণকারী নিদর্শনাবলির প্রতি নির্দেশ করে বলেছেন

اِنَّ فِيْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اخْتِلَافِ الَّيْلِ وَ النَّهَارِ لَاٰيٰتٍ لِّاُولِي الْاَلْبَابِ،الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ قِيٰمًا وَّ قُعُوْدًا وَّ عَلٰي جُنُوْبِهِمْ وَ يَتَفَكَّرُوْنَ فِيْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلًا سُبْحٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ،رَبَّنَاۤ اِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ اَخْزَيْتَهٗ  وَ مَا لِلظّٰلِمِيْنَ مِنْ اَنْصَارٍ.

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতেদিবস ও রজনীর পরিবর্তনে অবশ্যই নিদর্শনাবলি রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্নদের জন্য। যারা দাঁড়িয়েবসে ও পার্শ্বশয়নে আল্লাহকে স্মরণ করে। আর আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করে ও বলেহে আমাদের পালনকর্তা! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করোনি। তুমি পবিত্র মহান। তুমি আমাদেরকে রক্ষা করো জাহান্নামের শাস্তি থেকে ।  সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯০-১৯১

শক্ত কঠিন ফলের আঁটি ও শস্যদানা থেকে মাটির বুক চিরে নরম-কোমল অঙ্কুর বেরিয়ে আসে আল্লাহর অদৃশ্য শক্তিতে। এদিকে ইঙ্গিত করে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে

اِنَّ اللهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَ النَّوٰي  يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَ مُخْرِجُ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَيِّ ذٰلِكُمُ اللهُ فَاَنّٰي تُؤْفَكُوْنَ.

নিশ্চয় আল্লাহ শস্যবীজ ও আঁটি অঙ্কুরিত করেনতিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। তিনিই তো আল্লাহ। সুতরাং তোমরা কোথায় ফিরে যাবেসূরা আনআম (৬) : ৯৫

মানুষ তার অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা লক্ষ্য করলে নিশ্চিতভাবে প্রত্যক্ষ করবেসৃষ্টজগতে সর্বত্র আল্লাহর অস্তিত্ব ও কুদরতের নিদর্শনাবলি বিস্তৃত হয়ে আছে। স্বয়ং মানুষের অস্তিত্বের মাঝেও তাঁর বিস্ময়কর কুদরতের নিদর্শনাবলি বিদ্যমান।

মানুষ কি ভেবে দেখে না তার এ সুন্দর আকার আকৃতি মাতৃগর্ভে কে তৈরি করেছেনকে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তিসম্পন্ন চোখ-কান সৃষ্টি করেছেনকে স্বাদ আস্বাদনকারী জিহ্বা ও ঘ্রাণশক্তিসম্পন্ন নাক তৈরি করেছেনকে তাকে চিন্তা ও বাকশক্তি দান করেছেনকে সৃষ্টি করেছেন তার জন্য মাতৃস্তনে দুধের স্রোতধারাকার করায়ত্তে তার সুস্থতা-অসুস্থতাকে তার জীবন-মৃত্যুর মহানিয়ন্তাপ্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে তার বিবেক বলতে বাধ্য হবেসবই সৃষ্টি করেছেন সেই মহাসত্তাযিনি অদৃশ্যমানমহাপ্রজ্ঞাময়অসীম শক্তি ও ক্ষমতার আধারমহাপরাক্রমশালী।

তিনিই আল্লাহ। বিশ্বাসীগণের বিবেকের কাছে এ প্রশ্ন রেখে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে

وَ فِي الْاَرْضِ اٰيٰتٌ لِّلْمُوْقِنِيْنَ،وَ فِيْۤ اَنْفُسِكُمْ اَفَلَا تُبْصِرُوْنَ، وَ فِي السَّمَآءِ رِزْقُكُمْ وَ مَا تُوْعَدُوْنَ.

আর বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে আমার নিদর্শনাবলি এবং স্বয়ং তোমাদের মাঝেও। সুতরাং তোমরা কি অনুধাবন করবে নাআকাশে বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে তোমাদের জীবনোপকরণ ও তোমাদেরকে যা কিছুর প্রতিশ্রম্নতি দেয়া হয়েছে। সূরা যারিয়াত (৫১) : ২০-২১

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে তাঁর অস্তিত্ব ও কুদরত প্রমাণে দার্শনিক ও যুক্তিতর্কের ভাষা অবতারণার পরিবর্তে সচরাচর ও দৃশ্যমান বস্তুসমূহের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। যেন মানুষ এসব দৃষ্টান্ত নিয়ে চিন্তা করে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব ও কুদরতের প্রমাণ খুঁজে পায়। ইরশাদ হয়েছে

اَلَمْ تَرَ اَنَّ اللهَ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً  فَاَخْرَجْنَا بِهٖ ثَمَرٰتٍ مُّخْتَلِفًا اَلْوَانُهَا وَ مِنَ الْجِبَالِ جُدَدٌۢ بِيْضٌ وَّ حُمْرٌ مُّخْتَلِفٌ اَلْوَانُهَا وَ غَرَابِيْبُ سُوْدٌ،وَ مِنَ النَّاسِ وَ الدَّوَآبِّ وَ الْاَنْعَامِ مُخْتَلِفٌ اَلْوَانُهٗ كَذٰلِكَ اِنَّمَا يَخْشَي اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمٰٓؤُا  اِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ غَفُوْرٌ.

তুমি কি দেখছ নাআল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং আমি তা দ্বারা বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উৎপন্ন করি। আর পাহাড়সমূহের মধ্যেও আছে বিচিত্র বর্ণের অংশশুভ্রলাল ও নিকষ কালো। অনুরূপভাবে রয়েছে বিচিত্র রঙের মানুষচতুষ্পদ জন্তু ও গৃহপালিত পশু। আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে যারা জ্ঞানী তারাই তাঁকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল।সূরা ফাতির (৩৫) : ২৭-২৮

পানির চরিত্র হলউপর থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। পানি নিচ থেকে উপরের দিকে ওঠাতে হলে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও কৃত্রিম শক্তি  প্রয়োগ করে উত্তোলন করতে হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে পানি জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়ে তা আকাশে উত্তোলিত হয়সেই জলীয় বাষ্প মেঘমালায় পরিণত হয়ে বৃষ্টিরূপে বর্ষিত হয়। পৃথিবীতে এমন কোনো মহাশক্তি রয়েছেযা পানিকে এভাবে জলীয় বাষ্পে পরিণত করে আকাশে উত্তোলন করবেআবার আকাশ থেকে তা বৃষ্টিরূপে যমীনে বর্ষণ করবেনিশ্চয় এমন কোনো অদৃশ্য মহাসত্তা রয়েছেনযাঁর মহাজাগতিক নিখুঁত কর্মপরিকল্পনায় পানি নিজ চরিত্রের বিপরীতে জলীয় বাষ্পে পরিণত হয় এবং আকাশে  মেঘমালায় রূপান্তরিত হয়ে বৃষ্টি আকারে পৃথিবীতে নেমে আসে। এ থেকে প্রমাণিত হয়সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ই এভাবে বিস্ময়কর পদ্ধতিতে আকাশ থেকে যমীনে বৃষ্টি বর্ষণ করেন।

আকাশ থেকে বর্ষিত পানির মাধ্যমে  যমীন সতেজ-উর্বর ও চাষাবাদযোগ্য হয়। তা থেকে বৈচিত্র্যময় ফলমূলশাকসবজি ও খাদ্যশস্য  উৎপন্ন হয়।

কুরআনুল কারীমের ভাষায়

فَاَخْرَجْنَا بِهٖ ثَمَرٰتٍ مُّخْتَلِفًا اَلْوَانُهَا.

আমি আল্লাহ তা (আকাশ থেকে বর্ষিত পানি) দ্বারা রংবেরঙের ফলমূল উৎপন্ন করি। সূরা ফাতির (৩৫) : ২৭

যমীন থেকে এ ফলমূল ও শস্যদানা উৎপন্নকারী হলেন স্বয়ং মহা প্রজ্ঞাময় আল্লাহ। কৃষক যদিও যমীন চাষাবাদ করে তাতে বীজ-শস্যদানা বপন করেকিন্তু উক্ত বীজ ও শস্যদানা অঙ্কুরিত করে তা মাটির বুক চিরে নির্গতকারী কৃষক নয়। কৃষক তো শুধু  চাষাবাদ ও বীজ বপনকারী। কিন্তু বপনকৃত বীজ বিদীর্ণ করাতাতে অঙ্কুর সৃষ্টি করে মাটি ভেদ করে তা নিয়ে আসা এটা নিঃসন্দেহে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সর্বময় শক্তি ও ক্ষমতার আধার মহা পরাক্রমশালী আল্লাহরই কাজ।

তদুপরি এ অঙ্কুর এমনই নরম-কোমলযা মাটি থেকে উপড়ে ফেলতে দুর্বল হাতের আঙ্গুলই যথেষ্ট। অথচ এমন শক্তিশালীযা শক্ত মাটির বুক চিরে অনায়াসে বেরিয়ে আসে। নরম-কোমল অঙ্কুরে শক্ত মাটি ভেদ করার শক্তি দানকারী একজন মহাসত্তা নিশ্চয় রয়েছেন।

ভূপৃষ্ঠস্থিত পানিকে জলীয় বাষ্পে পরিণত করে বৃষ্টিবাহী মেঘমালায় রূপান্তরিত করাআকাশ থেকে তা পৃথিবীতে বর্ষণ করাবপনকৃত শক্ত কঠিন বীজ মাটির নিচে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফেটে যাওয়া এবং তা থেকে নরম-কোমল অঙ্কুর মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসার শক্তি দানকারী নিঃসন্দেহে মহা ক্ষমতাধর আল্লাহ ছাড়া কেউ নয়।

আকাশ থেকে বর্ষিত পানির মাধ্যমে আল্লাহ বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উৎপন্ন করেন। আপেলআনারআঙ্গুরআমকাঁঠাল আরো কত বিচিত্র রংবৈচিত্র্যময় আকার আকৃতি ও নানান স্বাদের ফলমূল রয়েছে। প্রত্যেক প্রকার ফলের মধ্যে আবার বিচিত্র রংস্বাদআকার ও আকৃতিগত ভিন্ন ভিন্ন জাত ও শ্রেণী রয়েছে। সুন্দরতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কতই না মহিমাময়! অথচ সর্বপ্রকার ফলেরই উৎসস্থল মাটিমাটির ভেতর থেকেই সব উৎপন্ন হয়। কিন্তু প্রত্যেক প্রকার ফলের রং ভিন্ন ভিন্ন। রংস্বাদ ও আকার-আকৃতি সৃষ্টি যদি মাটির নিজস্ব চরিত্র হততাহলে এক ও অভিন্ন স্বাদরং ও আকার-আকৃতিবিশিষ্ট বস্তুই শুধু মাটি উৎপন্ন করত। সুতরাং মাটি থেকে উৎপন্ন যাবতীয় ফল-মূলশস্যদানা ও বৃক্ষ তরুলতায় রংস্বাদ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্র্য সৃষ্টিকারী মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউ নয়।

রং ও বর্ণগত এ বৈচিত্র্য শুধু ফলমূলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়বরং ভূপৃষ্ঠে বিদ্যমান পাহাড়-পর্বতমালাও এর ব্যতিক্রম নয় কোনোটি শুভ্রকোনোটি লাল এবং কোনোটি নিকষ কালো। বিচিত্র রং ধারণ যদি পাহাড়ের নিজস্ব চরিত্র হততাহলে পৃথিবীর সব পাহাড়-পর্বত অভিন্ন রংবিশিষ্ট হত। পাহাড়-পর্বতমালার এ রংবৈচিত্র্য কে সৃষ্টি করলেননিঃসন্দেহে স্বাধীন কর্মবিধায়ক আল্লাহ তাআলাই আপন ইচ্ছানুযায়ী এ রংবৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন।

এমনিভাবে প্রাণীজগতের দিকে তাকালে দেখা যায়অসংখ্য জীবজন্তু বিচিত্র রং ও আকার আকৃতিতে পৃথিবীতে বিচরণ করছে। উটঘোড়াহাতিবাঘভাল্লুকগরুছাগলগাধাভেড়াহরিণ ইত্যাদি একেক জাতের চতুষ্পদ জন্তু একেক রং-বর্ণ ও আকার-আকৃতিবিশিষ্ট। আবার প্রত্যেক জাতের প্রাণীর মধ্যে রয়েছে সাদা-কালো-লাল তথা বহুবিধ রং ও বর্ণবৈচিত্র্য। রং-বর্ণ ও আকার-আকৃতি ধারণ যদি প্রাণীজগৎ ও জড়জগতের ফিতরাত ও স্বভাবের দাবি অনুযায়ী হততাহলে সব অভিন্ন রং-বর্ণ ও আকার-আকৃতিবিশিষ্ট হত। কিন্তু স্বভাব-বিরুদ্ধভাবে এ বিস্ময়কর রং ও বর্ণবৈচিত্র্য কীভাবে  সৃষ্টি হলসন্দেহাতীতভাবে সেই মহাসত্তার সৃষ্টি কুশলতায়যাঁর করায়ত্বে সৃষ্ট জগতের একক ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা।

স্বয়ং মানুষের অস্তিত্বের মধ্যে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের প্রমাণ ভাস্বর হয়ে আছে। মানুষ যদি নিজে আপন  অস্তিত্ব দানকারী হততাহলে ফিতরাত ও স্বভাবের দাবি অনুযায়ী জগতের সব  মানুষ একই ভাষা-বর্ণআকার-আকৃতি ও রুচি-পছন্দবিশিষ্ট হত। অভিন্ন পিতা-মাতা থেকে একাধিক সন্তান জন্মগ্রহণ করেঅথচ তাদের আকার-আকৃতিস্বভাব-প্রকৃতি অভিন্ন নয়। তাদের ভাষা-বর্ণদৈহিক গঠন-চরিত্র ও চলন-বলন ভিন্ন ভিন্ন। একই মা থেকে জন্মলাভকারী ভাই-বোনদের একজনের সাথে অপরজনের আচরণ-উচ্চারণরং ও কণ্ঠস্বরের কোনো সাদৃশ্য নেই। এ সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টিকারী অদৃশ্য একজন মহাসত্তা নিঃসন্দেহে বিদ্যমান রয়েছেন। তিনিই হলেন সর্বশক্তিমান মহা প্রজ্ঞাময় আল্লাহ। ইরশাদ হয়েছে

وَ مِنْ اٰيٰتِهٖ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اخْتِلَافُ اَلْسِنَتِكُمْ وَ اَلْوَانِكُمْ  اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّلْعٰلِمِيْنَ.

আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্য থেকে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে বহুবিধ নিদর্শন। সূরা রূম (৩০) : ২২                     

মানুষ যদি আল্লাহকে চিনতে চায়তাহলে সৃষ্টজগতে প্রতিটি বস্তুর মধ্যকার এ ভিন্নতা আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। ভাষা-বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত পার্থক্যপাহাড়-পর্বতগাছ-গাছালিবৃক্ষ-তরুলতাজীবজন্তু ও পশু-পাখির মধ্যকার পার্থক্য এ সবই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ করে।

সৃষ্টজগতে এক ও অভিন্ন আকৃতির কোনো বস্তু নেইবরং জড় ও প্রাণীজগৎ নির্বিশেষে প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য ও ভিন্নতা সুস্পষ্ট।

মানুষ যদি আল্লাহর সৃষ্ট মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে কিছু বানাতে চায়তাহলে সেও অভিন্ন রং ও আকৃতির কোনো বস্তু বানাতে ইচ্ছুক নয়। সে চায় তার সৃষ্টিকর্মে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে। মানব চরিত্রে তার রুচি-পছন্দ এবং ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের এ বৈচিত্র্য কে সৃষ্টি করেছেনমোটকথামহাজগতে প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে স্বভাব ও চরিত্রের ভিন্নতারং ও আকার-আকৃতির ভিন্নতামানুষের চিন্তা ও চেতনার ভিন্নতাআকল ও বুদ্ধি-বিবেচনার ভিন্নতাইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিন্নতারুচি ও পছন্দের ভিন্নতাভাষা ও বর্ণের ভিন্নতামেধা ও প্রতিভার ভিন্নতা নিঃসন্দেহে এ সবকিছু সুসংঘটিত হচ্ছে কোনো এক মহাসত্তার অসীম কুদরতী ব্যবস্থাপনায়। তিনিই হলেন নিরঙ্কুশ শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ। তিনিই সবকিছুর অব্যর্থ কার্যসম্পাদনকারী। মানুষ যদি আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ পেতে চায়তাহলে সে নিজেকে নিয়ে ভাবুকপাহাড়-পর্বতমালার দিকে তাকাকমহাজাগতিক বিচিত্র সৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করুক। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুকণা থেকে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি পর্যন্ত মহাজগতের যেদিকেই তাকাবেসেদিকেই সে আল্লাহর অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ খুঁজে পাবে। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে

اَفَلَا يَنْظُرُوْنَ اِلَي الْاِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ،  وَ اِلَي السَّمَآءِ كَيْفَ رُفِعَتْ، وَ اِلَي الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ، وَ اِلَي الْاَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ، فَذَكِّر  اِنَّمَاۤ اَنْتَ مُذَكِّرٌ.

তবে কি তারা তাকিয়ে দেখে না উটের দিকেকীভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছেএবং আকাশের প্রতিকিভাবে তাকে উঁচু করা হয়েছেএবং পর্বতমালার দিকেকীভাবে তা স্থাপন করা হয়েছেএবং ভূপৃষ্ঠের দিকেকীভাবে তা বিস্তৃত করা হয়েছেসুতরাং তুমি উপদেশ দান করোনিশ্চয়ই তুমি তো একজন উপদেশদাতা। সূরা গাশিয়াহ (৮৮) : ১৭-২১

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভের অনেক পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। সব পদ্ধতির নির্যাস হলআল্লাহ তাআলার কুদরত ও অসীম ক্ষমতার কিছু নিদর্শন মানব সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমানকিছু নিদর্শন মহাজগতের অসংখ্য সৃষ্টিসমূহের মধ্যে বিদ্যমান। এসব নিদর্শন চেনা ও প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভে সক্ষম। সৃষ্টজগতের কোনো কিছু আপনা থেকে অস্তিত্ব লাভ করেনিবরং নিশ্চিতভাবে কোনো মহাপ্রজ্ঞাবান সত্তা অস্তিত্ব দান করেছেন। যিনি সবকিছু তাঁর সুনিপুণ হাতে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। নাস্তিকরা আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। তাদের দাবিসবকিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনা থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে। তাদের এ দাবি চরম মূর্খতা এবং স্বভাব ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ বৈ কিছু নয়। বস্তুত দলীল ও যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভ করা সবার কাজ নয়বরং প্রকৃতিগতভাবে অন্তরে সৃষ্ট বিশেষ শক্তি মানুষকে এ বিশ্বাসের উপর বাধ্য করেসমগ্র মহাজগৎকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দানকারী এবং সুনিপুণ হাতে পরিচালনাকারী একজন মহাসত্তা রয়েছেন।

প্রকৃত বাস্তবতা হলআল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর পরিচয় লাভ দলীল-প্রমাণের মুখাপেক্ষী নয়বরং অন্তরের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ বিশ্বাস সৃষ্টি হয়মহাজগতের একজন নির্মাতা রয়েছেন। অবুঝ  শিশু এবং ঈমানের ছোঁয়া পায়নি এমন অমুসলিমও বিষয়টি দৃঢ়ভাবে অনুভব করেযদিও সে কোনো স্কুল-কলেজ বা মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ করেনি। কিন্তু অন্তর্জগতে সে ঠিকই কল্পনা করেসৃষ্ট জগতের একজন স্রষ্টা রয়েছেন।

মানুষ যদি চিন্তা করেতাহলে পদে পদে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ দেখতে পাবে। মানুষ হাজারো আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেঅসংখ্য কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে। কিন্তু সফলতা একশর মধ্যে দু-চারটিতে দেখতে পায়। বাকিগুলোতে ব্যর্থ হয়। অথচ কোনো মানুষ কি চায়সে ব্যর্থ হোককেউ কি চায়সে ব্যবসা করবে আর ক্ষতিগ্রস্ত হবেলাভের জন্যই তো সে ব্যবসা নিয়ে বসেছে। কিন্তু অসংখ্য জায়গায় তাকে ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হয়। এ ক্ষতি ও ব্যর্থতাদানকারী এবং তার প্রত্যাশা ও ইচ্ছার বিপরীতে পরিচালনাকারী কে?

মানুষ চায়তার সন্তান সন্ততি হোক। বিবাহের পর বিশ-ত্রিশ বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। বহুবিধ চিকিৎসা সে গ্রহণ করেবিভিন্ন দুআ-তাবিজ ব্যবহার করে। কিন্তু সন্তান তার হয় না।

কেউ চায়তার সন্তান-সন্ততি না হোক।  এজন্য সে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করে। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের পর তার সন্তান প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে যায়। মোটকথামানুষ চায় তার সন্তান না হোককিন্তু সন্তান হতে থাকে। আবার কেউ চায় তার সন্তান হোককিন্তু বিশ-ত্রিশ বছর এমনকি পুরো জীবন অতিবাহিত হয় নিঃসন্তান অবস্থায়।

কেউ চায়তার ব্যবসা যেন লাভজনক হয়অথচ সে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। আবার আরেকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়। মূলত এসব কিছুর মহাপরিকল্পনাকারী কে?

কেউ কি চায় মৃত্যুবরণ করতেপ্রত্যেকেই দীর্ঘজীবী হতে চায়। যখন মৃত্যুর আশঙ্কা সৃষ্টি হয়তখন জীবন বাঁচাতে হাজারো চিকিৎসা গ্রহণ করেমৃত্যু থেকে রক্ষা পেতে সম্ভব সব উপায়উপকরণ অবলম্বন করে। কিন্তু মৃত্যুর অমোঘ বিধানের সামনে রাজা-বাদশাআমির-শাসককোটিপতি-শিল্পপতি প্রত্যেকেই অসহায়। যদি বিশাল অর্থ-বিত্তের বিনিময়ে বা প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে জীবন বাঁচানো সম্ভব হততাহলে জগতে কোনো রাজা-বাদশাআমির-শাসককোটিপতি-শিল্পপতি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত না। কিন্তু কেউ কোনোক্রমেই মরতে না চাওয়া সত্ত্বেও তার মৃত্যুর মুখোমুখী হতেই হয়। তাহলে কে সেই মহাসত্তাযার অমোঘ বিধান অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের মৃত্যু ঘটেকে সেই মহা ক্ষমতাধরযিনি মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জীবন ছিনিয়ে নেন?

আপন ইচ্ছায় আমরা পৃথিবীতে আসিনি এবং আপন ইচ্ছায় আমরা পৃথিবী ত্যাগ করব না। যখন পৃথিবীতে আসার সময় হয়েছে তখন আসতে বাধ্য হয়েছি। যখন প্রস্থানের সময় হবে তখন প্রস্থানে বাধ্য হব। আমরা বুঝিআমরা কোনো এক মহাশক্তির ইচ্ছার সামনে বাধ্য। বাধ্য বান্দার জন্য অবশ্যই কোনো না কোনো বাধ্যকারী রয়েছেন। আমরা মাখলুক বা সৃষ্টি। কিন্তু নিজেরা নিজেদেরকে সৃষ্টি করিনি। অবশ্যই আমাদের একজন খালেক বা স্রষ্টা রয়েছেনযিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আমরা বশিভূতআমাদেরকে বশকারি নিশ্চয়ই কোনো মহাসত্তা রয়েছেন। আমরা রিযিকপ্রাপ্তআমাদেরকে রিযিক দানকারী নিশ্চয়ই একজন মহাসত্তা রয়েছেন।

মোটকথাসৃষ্ট জগতের প্রতিটি পরতে পরতে মানুষ আল্লাহ ও তাঁর কুদরতের নিদর্শনাবলি প্রত্যক্ষ করে তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য।

সেজন্য আলকুরআনুল কারীম যেখানেই আল্লাহর অস্তিত্বের সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছেসেখানে তার্কিক ও দার্শনিক পদ্ধতি অনুসরণ করেনিবরং মানুষের সচরাচর প্রত্যক্ষ সহজাত বিষয়সমূহ উপস্থাপন করে বলেছেমানুষ! তোমরা তোমাদের সামনে দৃশ্যমান এসব বস্তু লক্ষ্য করো। এসবের মধ্যে তোমরা আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের প্রমাণ খুঁজে পাবে।

এ প্রসঙ্গে ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী রাহ.-কে কেউ আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করল। তিনি বললেনতুঁত বৃক্ষের পাতার দিকে লক্ষ্য কর। এর মাধ্যমেই আল্লাহর অস্তিত্ব বুঝতে পারবে।  কারণউক্ত পাতা থেকে যদি মৌমাছি রস আহরণ করে তার থেকে মধু নিঃসৃত হয়। ছাগলবকরিদুম্বা যখন খায়তার থেকে লাদি বের হয়। হরিণ যদি খায়তার থেকে মেশক বের হয়রেশম পোকা খেলে তার থেকে রেশমি সুতা বের হয়। (দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৭৮ সূরা বাকারা২১ নং আয়াতের তাফসীর)

অভিন্ন পাতাতা থেকে কখনো রেশম সুতা বের হচ্ছেকখনো মেশক বের হচ্ছেআবার কখনো...। নিঃসন্দেহে এটা গাছের পাতার চরিত্র নয়। পাতার চরিত্রই যদি হততাহলে তো  সর্বাবস্থায় একই বস্তু বের হততিন ধরনের বস্তু বের হত না। সুতরাং অবশ্যই এ পাতার চরিত্রের উপর কোনো অদৃশ্য কর্মবিধায়কের কর্মপরিকল্পনা কাজ করছে। তিনিই মূলত এর থেকে কখনো মেশকআবার কখনো রেশম সুতা নির্গত করছেন। মানুষ যদি সুষ্ঠু জ্ঞানে বুঝতে চায়তাহলে গাছের নগণ্য পাতা থেকেও আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ আহরণ করতে পারে। আর যদি বোঝার ইচ্ছা না থাকেতাহলে নবী-রাসূলগণ হাজারো যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করা সত্ত্বেওদিবানিশি মুজিযার পর মুজিযা প্রদর্শিত হওয়া সত্ত্বেও  উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। উপলব্ধি করার সৌভাগ্য আবু জাহলের কপালে ছিল নাফলে মৃত্যু পর্যন্ত সে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। অনুধাবন করা আবু লাহাবের ভাগ্যে জোটেনিফলে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত সে অনুধাবন করতে পারেনি। আর অনুধাবন করা ও মেনে নেয়ার সৌভাগ্য যাদের হয়েছেতাঁরা ঠিকই অনুধাবন করেছেন ও মেনে নিয়েছেন। ফলে কেউ সিদ্দীকে আকবর লকব পেয়েছেনকেউ ফারূকে আজম উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। 

বোঝা গেলযখন কেউ না মানার উপর বদ্ধপরিকর থাকেতখন আল্লাহ তাআলার অভিপ্রায় না থাকলে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলও তাকে মানাতে পারেন না। আর যদি কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়তখন তুঁত নামক বৃক্ষের ক্ষুদ্র পাতা থেকেও  সে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়ে যায়।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ.-কে কেউ জিজ্ঞেস করলআপনি কি মুসলমান?

তিনি বললেনহাঁ! আলহামদু লিল্লাহ।

লোকটি বললমুসলমান কাকে বলে?

তিনি বললেনযে আল্লাহর তাওহীদ ও একত্ববাদ বিশ্বাস করে।

সে বললআপনি কী করে জানলেনআল্লাহ একতাঁর অস্তিত্ব অবধারিততিনি মহাজগৎ সৃষ্টি করেছেন?

প্রতিউত্তরে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল যদি কুরআনুল কারীমের আয়াত এবং আকলনির্ভর যুক্তি-প্রমাণ ও দার্শনিক ভাষা উপস্থাপন করতেনতাহলে মূর্খ লোকটি তা অনুধাবনে সক্ষম হত না। তিনি তার যোগ্যতা অনুযায়ী তাকে সহজ সরল ভাষায় বুঝিয়ে বললেনআমি আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ উদ্ঘাটন করেছি এক আশ্চর্যজনক বস্তু থেকে। আমি পৃথিবীতে একটি রুপার তৈরি ঘর দেখেছি। তাতে কোনো ছিদ্রপথ নেইআলো-বাতাস বহির্গমন-নির্গমনের কোনো ব্যবস্থা নেই। নিশ্ছিদ্র উক্ত ঘরের অভ্যন্তরে আরেকটি সোনার তৈরি ঘর অবস্থিত। তাতেও দরজা-জানালা নেইআলো বাতাস বহির্গমন ও নির্গমনের কোনো পথ নেই। ঘরদুটিতে না ভেতর থেকে কিছু বের হতে পারে আর না বাইরে থেকে কিছু ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। একটি ঘর বাইরে এবং অপরটি তার অভ্যন্তরে। আমি হতভম্ব হয়ে তা দেখছিলাম। হঠাৎ উক্ত ঘরের প্রাচীর ভেদ করে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটি জীবন্ত প্রাণী। মানবশিশু তো ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর জ্ঞানশূন্য থাকে। কিন্তু প্রাচীর ভেদকারী জীবন্ত প্রাণীটি পরিপক্ব ও অভিজ্ঞ প্রাণীর মতো আচরণ শুরু করে দিল। আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম ও নিশ্চিতভাবে বুঝে নিলাম এ নিশ্ছিদ্র গৃহে বাইরে থেকে কেউ ভেতরে প্রবেশ করেনিঅথচ দৃশ্যমান কোনো কার্যকারণের ভূমিকা ব্যতিরেকেই ভেতর থেকে একটি জীবন্ত প্রাণী বেরিয়ে এল। সুতরাং নিঃসন্দেহে এই কার্যক্রমের আড়ালে অদৃশ্যমান কোনো একজন কর্মবিধায়ক রয়েছেনযাঁর কুদরতী হাতে এ জীবন্ত প্রাণীর অস্তিত্ব লাভ। আমি অকুণ্ঠচিত্তে বিশ্বাস করলাম ও নিশ্চিত হলামতিনিই হলেন দৃশ্য-অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ।

লোকেরা বললজনাব! এমন অদ্ভুত রুপার ঘর আপনি কোথায় পেলেনআবার উক্ত রুপার ঘরের অভ্যন্তরে আরেকটি সোনার ঘর! এমন ঘর তো আমরা কস্মিনকালেও দেখিনি। এ বিস্ময়কর ঘর আপনি কোন্ জগতে দেখেছেন?

তিনি বললেনএমন ঘর তোমাদের মাঝেই বিদ্যমান।

লোকেরা বললআমরা তো দেখছি না।

তিনি বললেনতোমরা চোখ বন্ধ রাখলে আমি কী করে দেখাবএমন ঘর তো তোমাদের আপন আপন গৃহেই বিদ্যমান। আচ্ছা! তোমরা কি ডিম দেখনিসেটি হল রুপার ঘর। তার ভেতরে সুরক্ষিত হলুদ রঙবিশিষ্ট যে কুসুম রয়েছেতা হল সোনার ঘর। তাতে আলো-বাতাস নির্গমন ও বহির্গমনে কোনো ছিদ্রপথ নেই। ভেতর থেকে কিছু বাইরে আসে না এবং বাইরে থেকে কিছু ভেতরে প্রবেশ করে না। (সংক্ষিপ্তভাবে মূল ঘটনাটি দেখা যেতে পারে তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৭৮তাফসীরে কাবীরইমাম রাযী রাহ. ১/১০৯ সূরা বাকারা ২১ নং আয়াতের তাফসীর)

উক্ত ডিম মুরগি তার পেটের নিচে নিয়ে বসে যায়। কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ ডিমের উভয় ঘরের প্রাচীর ফেটে যায়। তা থেকে মুরগীর জীবন্ত বাচ্চা বেরিয়ে আসে। সে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত মুরগীর ন্যায় আচরণ শুরু করে দেয়। অথচ না সে কোনো পাঠশালায় গিয়েছে আর না কোনো বিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছে আর না মা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করেছে। অথচ মা যেভাবে মাটি থেকে শস্যদানা কুড়িয়ে খায়সেও ঠিক সেভাবে কুড়িয়ে খায়। মা যেভাবে কথা বলেসেও অভিন্ন ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। কিন্তু একজন মানব সন্তান যতক্ষণ না তাকে পাঠশালায় বসানো হবেযে পর্যন্ত না সে মায়ের ভাষা আত্মস্থ করবেকিছুতেই সে কবি সাহিত্যিক হবে না। সে অন্য ভাষা আয়ত্ব করবে তো দূরের কথাপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতীত আপন মাতৃভাষায়ও লেখাপড়া বুঝতে সক্ষম হবে না। একজন মানব শিশু যেখানে যথাযোগ্য শিক্ষক থেকে শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণ ব্যতীত স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতে সক্ষম হয় না। ভাষা-সাহিত্য শেখার জন্য তাকে দেশ দেশান্তর ছুটে বেড়াতে হয়। অথচ সোনা-রূপার অদ্ভূত ঘর সদৃশ ছোট্ট ডিম থেকে এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবন্ত বাচ্চা কিচিরমিচির শব্দে বের হয়েই সে হুবহু মায়ের অনুরূপ আচার-আচরণ শুরু করে দেয়। যেন সে যথাযথ শিক্ষা-দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে মায়ের উদর থেকে জন্মলাভ করেছে।

সোনা-রুপার এ নিশ্ছিদ্র ঘর সদৃশ ক্ষুদ্রকায় ডিমের মধ্যে কে তাকে শেখালকে তাকে আত্মরক্ষার দীক্ষা দান করলকে তাকে মনের কথা প্রকাশের অনুশীলন করালকে তাকে বলে দিলডিমের নিশ্ছিদ্র প্রাচীর ভেদ করে বের হওয়ামাত্র সে দানাপানি কুড়ানো শুরু করবে। এ শিক্ষা ও দীক্ষা কে তাকে প্রদান করলঅবধারিতভাবে সেই মহাসত্তাযিনি তাঁর ঐশী গ্রন্থে ঘোষণা করেছেন

رَبُّنَا الَّذِيْۤ اَعْطٰى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهٗ ثُمَّ هَدٰى.

আমাদের পালনকর্তা তিনিযিনি প্রতিটি বস্তুকে তার সৃষ্টিগত আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন। সূরা ত্বহা (২০) : ৫০ 

2 Comments

  1. This website is a treasure trove of information! Love the clean layout and user-friendly interface.

    ReplyDelete
  2. Couldn't agree more with the wisdom shared on this site.

    ReplyDelete
Previous Post Next Post